নিজস্ব প্রতিবেদক : বাজেট আসলেই মানুষ জীবন যাপনের ব্যয় বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তা করতে হয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট সাধারণ মানুষের কাছে বাজেট মানেই আতংক।
রোববার (৯ জুন ) রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের মওলানা আকরাম হলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ আয়োজিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট পর্যালোচনা সভায় এসব কথা জানান আলোচকরা। এতে বক্তৃতা করেন দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সহ-সভাপতি ফখরুল ইসলাম বাবু, সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রমুখ। সভায় লিখিত বক্তৃতা তুলে ধরেন জাসদের সাধারণ সম্পাদক শিরিন আখতার।
বক্তৃতায় বলা হয়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ক কমানো, ১০ লক্ষ মানুষকে নতুনভাবে ভাতার আওতায় আনা, দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষা, কৃষি উপকরণের উপর প্রণোদনা দেয়া, সারের ভর্তুকি অব্যাহত রাখা সহ কিছু পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দেয়ার কথা থাকলেও এ বাজেট গতানুগতিক এবং স্থিতাবস্থা বজায় রাখার প্রচেষ্টার বাইরে নতুন ও বেশি কিছু না। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ডলার সংকট মোকাবেলা, ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের বিশৃংখলা ও অস্থিরতা দূর করা, রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জণ, অভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং খাত এবং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাওয়া, লাগামহীন দুর্নীতি ও অর্থপাচার রোধ, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য রোধ ও কমানো প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন ও আগামী অর্থনীতির জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট সাধারণ মানুষের কাছে বাজেট মানেই আতংক। সাধারণ মানুষ কোন জিনিসের দাম কতটুকু বাড়বে, তাদের জীবনযাপন ব্যয় কতটুকু বাড়বে- এগুলো নিয়েই চিন্তিত। অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলকে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সংকট মোকাবেলার পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতি, বাজেটের নীতি-কাঠামো, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা, শাসন-প্রশাসন নিয়ে ভাবতে হয়।
জাসদের পক্ষ থেকে বাজেটে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমিয়ে আনা, রাজস্ব আহরণ ও কর ন্যায্যতা সৃষ্টিতে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত,ব্যাংকিং খাতের শৃংখলা ফিরিয়ে আনা, ডলার সংকটে করণীয়, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার রোধ, বৈষম্য বৃদ্ধি ও সামাজিক সুরক্ষা আওতা বাড়ানো, শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের মজুরি বৃদ্ধি, সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত, শিক্ষা বাজেটে জিডিপির ৮ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া, সাংস্কৃতিক খাতে বরাদ্দ বাড়ানো এবং মোবাইল ফোনের টকটাইম, ইন্টারনেট ডাটার উপর শুল্কবৃদ্ধির প্রস্তাব প্রত্যাহারের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা তুলে ধরে বলা হয়, সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে এখনও মূল্যস্ফীতি ৯.৮৭ শতাংশ। উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই চাপ কমিয়ে আনতে সরবরাহ শৃংখলের ত্রুটি দূর করা, একচেটিয়া ব্যাবসা নিয়ন্ত্রণে আনতে আমদানির উচ্চসীমা নির্ধারণ এবং সরবরাহ শৃংখলে যুক্ত সকলকে লাইসেন্স ও মনিটরিংয়ে আনা, আভ্যন্তরীণ বাজারে সিন্ডিকেটের দাপট ও কারসাজি , চাঁদাবাজি ও বখরাতন্ত্র বন্ধ করা। সামষ্টিক অর্থনীতির সমন্বয় সাধন, প্রয়োজনীয় নিত্যপণ্য যথাসময়ে আমদানি করা, ডলার সহ বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে টাকার মান অবমূল্যায়ন মোকাবেলা করা, বাজেটের ঘাটতি ৪.৫ শতাংশ থেকে ৩.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি কাটছাট করে যে প্রকল্পের কাজ শেষের পথে সেগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে সম্পন্ন করা, রাজনৈতিক বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় নতুন প্রকল্প গ্রহণ না করা, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কঠোরভাবে বন্ধ করা ও কৃচ্ছতা সাধন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার সংশোধন করে বাস্তবসম্মত ও যৌক্তিক করা। রাজস্ব আহরণ ও কর ন্যায্যতার জন্য রাজস্ব আহরণের এই লক্ষ্য মাত্রা অর্জনে বর্তমানে চিহ্নিত ও নিয়মিত কর প্রদানকারীদের উপর বাড়তি কর চাপিয়ে আদায় করার বদলে কর জাল বিস্তৃত করে ইচ্ছাকৃত কর ফাঁকিদাতা ও কর প্রদানে সক্ষম ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে করের অওতায় আনা জরুরি। রাজস্ব আহরণে পরোক্ষ কর ও ভ্যাটের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। ভ্যাট ধনি-গরীব সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য- এটা কর অন্যায্যতা। কর কাঠামোর সংস্কার ও ন্যায্যতা প্রদান করতে হবে। ধনীদের উপর কর বাড়াতে হবে। ১ কোটি টাকা কর দিতে সক্ষম এমন করদাতার সংখ্যা এখন দেশে কয়েক লক্ষ, তাদের করের আওতায় এনে তাদের কাছ থেকে কর আদায় করতে হবে। সাধারণ করদাতাদের আয়ের উপর সর্বোচ্চ ৩০শতাংশ কর, আর কালো টাকা সাদা করতে ১৫শতাংশ কর প্রদানের সুযোগ দেয়া অনৈতিক ও অন্যায্য। বরং কালো টাকার মালিকদের অপ্রদর্শিত আয় ও সম্পদ আয়কর রিটার্নে প্রদর্শনের শেষ সুযোগ দেয়া যেতে পারে। এরপরও কালো টাকার মালিকরা তাদের অপ্রদর্শিত অর্থ-সম্পদ আয়কর রিটার্নে প্রদর্শন এবং প্রযোজ্য কর প্রদান না করলে তা বাজেয়াপ্ত করতে হবে। এতে দুর্নীতির পথে আয়-ভোগ বন্ধ হবে। অর্থ পাচার রোধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অটোমেশন দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার রোধে রাজস্ব বোর্ডের ইন্টিলিজেন্স ইউনিটকে শক্তিশালী করতে হবে। রাজধানী ঢাকা মহানগর সহ বড় বড় নগর শহরে বসবাসকারীদের মধ্যে ১ কোটি ৩০ লাখ পরিবার দেশের ৪৫ ভাগ সম্পদের মালিক, কিন্তু এরা কর জালের বাইরে আছে। তাদের কর জালে আনতে হবে।
তাছাড়া ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও আস্থাহীনতার কারণে ব্যাংকে আমানত বাড়ছে না। অন্যদিকে খেলাপী ঋণ ও ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপী বাড়ছে। ১০টি ব্যাংক দূর্বল ব্যাংক হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। দূর্বল ব্যাংকগুলোকে তথাকথিত সবল ব্যাংকের সাথে একিভূত করার কৌশল আমানতকারীদের আস্থা ফেরাতে পারছে না এবং জোরকরে একিভূত করার কৌশলও কাজ করছে না। ব্যাংকিং খাতের এই অস্থিতিশীলতা দূর করার জন্য সুনির্দিষ্ট স্বচ্ছ উদ্যোগ ও পদক্ষেপ দরকার।
ডলার ও টাকার মানের ভারসাম্যহীনতা দূর করা, রপ্তানী আয় দেশে ফেরত না আসা, বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া বন্ধ করা, প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিটেন্সের উপর প্রণোদনা বৃদ্ধি করে ৩শতাংশে উন্নীত করা, বৈদেশিক বানিজ্যে ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে আঞ্চলিক ও জাতীয় মুদ্রায় লেনদেন চালু করা, রিজার্ভের উপর চাপ কমাতে ও ডলার সংকট কাটাতে বেসরকারি ও ব্যক্তিখাতে ব্যক্তি মালিকানাধিন বিদ্যুৎ কোম্পানীগুলোর সাথে উৎপাদন হোক বা না হোক ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়ার চুক্তি সংশোধন করে ‘নো প্রোডাকশন নো চার্জ’ চুক্তি করতে হবে।
বক্তারা বলেন, দুর্নীতির মাধ্যমে পাহাড়সম অর্থ সম্পদের মালিক হওয়া, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পাচার, রপ্তানির বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থ দেশে ফিরে না আসার রোমহর্ষক খবর প্রতিদিনই মিডিয়াতে প্রকাশিত হচ্ছে। দুর্নীতি বন্ধ, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আনা, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ গ্রহণ করে বেকার, কর্মহীন, আয়হীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, শ্রমজীবী-কর্মজীবী-সাধারণ মানুষের নিম্ম মজুরী ও পারিশ্রমিক, মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয় ও সীমিত আয়ের মানুষদের প্রকৃত আয় কমে যাওয়া, ঋণগ্রস্থ হওয়া এবং সঞ্চয় ও সম্পদ হারানো অন্যদিকে দুর্নীতির মাধ্যমে অস্বাভাবিক অর্থ সম্পদের মালিক হয়ে যাওয়ায় সমাজে বৈষম্য বেড়েই চলেছে। এ ক্রমবর্ধমান ভয়ংকর ও কুৎসিত বৈষম্য কমানো সমগ্র জাতি ও সমাজের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে। দুর্নীতি কঠোরভাবে বন্ধ করার জন্য দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ, বেকার-কর্মহীন-আয়হীন মানুষের ডাটাবেজ তৈরি করে কর্মসংস্থান নিশ্চিত এবং সামাজিক সুরক্ষাখাতের সুফলভোগীদের ডাটাবেজ তৈরি করে সামাজিক সুরক্ষাখাতের জাল আরো বিস্তৃত করে শিক্ষার বরাদ্দ ৮% বৃদ্ধি মোবাইল ফোন কল ও ডাটার উপর আরোপিত চার্জ প্রত্যাহার ও শ্রমিকদের ন্যূনতম ২৫ হাজার টাকা বেতন নির্ধারণ করার দাবি জানানো হয়।
###
বাবু/কর