নিজস্ব প্রতিবেদক: নগরীর পুরান ঢাকার অলিগলিতে অবৈধ ক্যামিক্যাল গোডাউন ও প্লাষ্টিক কারখানাগুলো যেন এক একটি অগ্নিবোমা। প্রায়ই এসব কারখানা ও গোডাউনে অগ্নিকাণ্ডে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটলেও নির্বিকার কতৃপক্ষ। গত দেড় যুগে ওই এলাকায় ছোটবড় অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ৩ শতাধিক মানুষের নির্মম মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি ঘটনার পরে দায়সারা তদন্ত কমিটি গঠন করে দায় শেষ করছে সংশ্লিষ্টরা।
এসব ঘটনায় দায়ের হওয়া অধিকাংশ মামলারই বিচার হয়নি। ফলে ওইসব বোমা সাদৃশ্য কারখানা ও গোডাউনগুলো বহাল তবিয়তে রয়েছে।
সরে জমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর লালবাগের রয়েল হোটেলে প্রবেশমুখের ডান পাশে তন্দুরি কিচেন। সাজানো টিপটপ রেষ্টুরেন্টটির দোতলার সিড়িটি সরু। বিভিন্ন পাটিকেল দিয়ে ইন্টেরিয়র সাজানো ইমার্জেন্সি বাহির হওয়ার দরজা নেই। নেই অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র ও ফায়ার লাইসেন্সও। পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডের হাজী ও হানিফ বিরিয়ানির সামনে এলপিজি গ্যাসের চুলা না থাকলেও হোটেলে ঢুকতে দুই পাশে এমন ভাবে টেবিল দেওয়া হয়েছে, দুজন মানুষ পাশাপাশি পার হতে পারছেনা। সেখানে
অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র নেই। ক্যাশ কাউন্টারে থাকা এক ব্যাক্তি নিজেকে রতন পরিচয় দিয়ে বলেন, আমাদের সকল ধরনের কাগজপত্র রয়েছে। কিন্ত তাৎক্ষনিক কোন কাগজ দেখাতে পারেননি। ওই সড়কটিতে অন্তত ১০টি ছোটবড় হোটেল রেস্টুরেন্ট পর্যাপ্ত আগ্নি নির্পাবন ব্যাবস্থা নেই । ওই এলাকায় ঘিঞ্জি সড়কে রাতদিন যানজটের পাশাপাশি উন্নয়নের নামে আশেপাশের অনেক সড়ক কাটা রয়েছে। এলাকার অলিগলি শুরু হয় ফায়ার সার্ভিসের থেকে অদূরে এলাকাটিতে অগ্নিকাণ্ড হলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে স্থানীয়রা।
সাতরওজা এলাকার নবাব,সুলতান'স ও লালবাগের রয়েল হোটেলসহ কেল্লার আশপাশের অভিজাতগুলোসহ মিটফোর্ড ও সদরঘাট এলাকায় অসংখ্য হোটেল রেস্তোরায় অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা নেই। কিছু হোটেলের খাবারের মানের প্রশংসা থাকলেও দামের রয়েছে গ্রাহকদের অস্বস্তি। হোটেল গুলোর প্রবেশপথে এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার রাখা বিপদজনক বলে জানিয়েছেন একাধিক ক্রেতা।
সেগুনবাগিচার তোপখানা রোডের ধানসিঁড়ি রেস্টুরেন্ট ও বৈশাখী রেস্তোরাঁ, গুলিস্তানের রাজধানী কোর্টকাচারী এলাকায় কালামস চিকেনসহ কয়েকটি হোটেলে সামনে পিছনে রান্নাঘর রয়েছে। আধিকাংশ হোটেলে এলপিজি গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। তাছাড়া হোটেল গুলোতে অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র কিংবা ফায়ারিং অ্যাস্টিংগুইশার অপার্যাপ্ত। কোন কোন হোটেলের প্রবেশ পথের দুই পাশ্বেই এলপিজি চালিত পরোটা ও গ্ৰিলের চুলা রয়েছে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের নেই ফায়ার লাইসেন্স।
এদিকে পুরান ঢাকার কাজী আলাউদ্দিন রোডের হাজী ও হানিফ বিরিয়ানির সামনে এলপিজি গ্যাসের চুলা না থাকলেও হোটেলে ঢুকতে দুই পাশে এমন ভাবে টেবিল দেওয়া হয়েছে, দুজন মানুষ পাশাপাশি পার হতে পারছেনা। সেখানে
অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র নেই। ক্যাশ কাউন্টারে থাকা এক ব্যাক্তি নিজেকে রতন পরিচয় দিয়ে বলেন, আমাদের সকল ধরনের কাগজপত্র রয়েছে। কিন্ত তাৎক্ষনিক কোন কাগজ দেখাতে পারেননি। ওই সড়কটিতে অন্তত ১০টি ছোটবড় হোটেল রেস্টুরেন্ট পর্যাপ্ত আগ্নি নির্পাবন ব্যাবস্থা নেই । ওই এলাকায় ঘিঞ্জি সড়কে রাতদিন যানজটের পাশাপাশি উন্নয়নের নামে আশেপাশের অনেক সড়ক কাটা রয়েছে। এলাকার অলিগলি শুরু হয় ফায়ার সার্ভিসের থেকে অদূরে এলাকাটিতে অগ্নিকাণ্ড হলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে স্থানীয়রা।
আমিনুল একজন ক্রেতা যুগান্তরকে বলেন, অভিজাত হোটেল গুলো অধিকাংশ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে চলেছে। অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা তেমন একটা নেই
জানাগেছে, পুরান ঢাকার নিমতলী ও ছুড়িহট্টাসহ ছোট-বড় শতাধিক দুর্ঘটনায় গত দেড় যুগে অন্তত ৩শত মানুষ নিহত হয়েছে। এসব দূর্ঘটনার জন্য দায়ী রাসায়নিক কেমিক্যালের গুদাম, পলিথিন ও প্লাষ্টিক কারখানা ওই এলাকা থেকে আজও স্থানান্তর হয়নি।
২০১০ সালের ৩ জুন রাজধানীর পুরনো ঢাকার নবাবকাটরার নিমতলীর ৪৩ নম্বর বাড়িতে রাত নয়টার দিকে কেমিক্যালের গুদামে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ১২৪জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। এরপর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ক্যামিক্যালের দোকান থেকে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন মারা যায়।
২০২২সালের ১৪ডিসেম্বর রাজধানীর চকবাজারের কামাল বাগে প্লাষ্টিক জুতার কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৬ জন ঘুমন্ত শ্রমিক দগ্ধ হয়ে মারা যায়। একই বছর কাপ্তান বাজার ও ২০২৩ সালে বঙ্গ বাজার অগ্নিকাণ্ডে কারো মৃত্যু না হলেও প্রচুর সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
নিমতলী ঘটনার পর পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকাগুলো থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর উদ্যোগ নেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এজন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস কেমিক্যাল ব্যাবসায়ীদের তালিকা তৈরি করে মন্ত্রী পরিষদে উপস্থাপন করবে। ওই সময় সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিস যৌথভাবে ১৯২৪জন ব্যাবসায়ীর তালিকা করে মন্ত্রীপরিষদ গঠিত উচ্চ পর্যায়ের কমিটির কাছে হস্তান্তরও করে। পরে ওই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্থায়ীভাবে মুন্সিগঞ্জের তুলশীখালীতে কেমিক্যাল পার্ক নির্মাণ করার দায়িত্ব শিল্পমন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বিসিক কে। এসময় আপদকালীন সুরক্ষা ব্যাবস্থা করার জন্য পোস্তগোলায় একটি কেমিক্যাল গোডাউন নির্মান করার জন্য বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাষ্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) কে দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে বিসিআইসি গোডাউন নির্মান করলেও আজও পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গুদাম সরেনি।
এখনো যথাস্থানে রয়ে গেছে রাসায়নিকের গুদাম। তাই আতঙ্ক নিয়েই বসবাস করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এখনোও ওই এলাকার অলি-গলিতে কেমিক্যাল গুদাম ও প্লাষ্টিকের জুতার কারখানা থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিমতলী, নবাবকাটরা, আগামসী লেন, চকবাজার এলাকার বাসিন্দারা।
নিমতলী ট্রাজেডিতে নিহত সাত বছর বয়সী বৈশাখের পিতা মামুন মিয়া বলেন,ওইদিন ঘটনার সময় আমার ছেলে দোকানে ঘুমিয়েছিল। গরম কেমিক্যাল আমার ছেলেকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে। আমি তখন দোকানের বাইরে ছিলাম। দৌড়ে দোকানের কাছে গিয়ে ছটফট করতে করতে আমার ছেলেকে মরতে দেখেছি। কিন্তু বাঁচাতে পারিনি। কারণ যেই বাঁচাতে যাবে, সেই মরবে। মামুন মিয়ার দাবি, নবাবকাটরা এলাকায় কেমিক্যালের গুদাম কমে গেছে। তবে পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। এখনও নবাবকাটরা, আগামসী লেন, নাজিরাবাজার, মিডফোর্ড, কায়েতটুলী, চকবাজার,ইমামগঞ্জ, সোয়ারীঘাট ও কেরানীগঞ্জের অনেক বাড়িতে গোপনে কেমিক্যালের গুদাম রয়েছে। তবে আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে।
ডিএসসিসির ৩৩নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাজী আব্দুল আওয়াল যুগান্তরকে বলেন, পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যালের অধিকাংশ গুদাম সরে গেছে। বিশেষ করে নবাবকাটরায় কেমিক্যালের গুদামের পরিমাণ আগের তুলনা অনেক কম।সিটি করপোরেশন ও অন্যান্য সংস্থার তৎপরতার মুখে এখন আর কোন বাড়িওয়ালা কেমিক্যালের গুদাম হিসেবে বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন না। যদিও অনেকেই গোপনে কেমিক্যাল গুদাম হিসেবে বাড়ি ভাড়া দিচ্ছে। এমন বাড়ির মালিকের সংখ্যাও কম। তবে পাশের ৩০ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে অধিকাংশ কেমিক্যাল ব্যাবসায়ী রয়েছে বলে জানান তিনি।
ডিএমপির লালবাগ জোনের পুলিশ কমিশনার মাহবুব উজ জামান যুগান্তরকে বলেন, লালবাগ এলাকায় হোটেল রেস্টুরেন্ট গুলোতে তদারকি করছে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনা এড়াতে সতর্ক রয়েছে। কারো বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রসিকিউশন দেয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।