বাংলামেইল ডেস্ক : বিশ্বের সব দেশেই কম-বেশি জঙ্গি-সন্ত্রাসী আছে। কিন্তু বিশাল এই ভূখণ্ডে জঙ্গিদেরও একটা দেশ আছে-আফগানিস্তান। কান্দাহারে ১৯৯৪ সালের এক সেপ্টেম্বরে প্রথম সংঘবদ্ধ আত্মপ্রকাশ। তার পর থেকেই আফগান আকাশে তালেবান সূর্য।
২০০১ সাল যুক্তরাষ্ট্রের টানা দুই দশকের সেনা অভিযানেও লুটিয়ে পড়েনি তালেবান ঝান্ডা। উলটো ২০২১ সালে তালেবান নিপাত অভিযানের হাল ছেড়ে ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফেরা’র মতো যুক্তরাষ্ট্রের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফুলেফেঁপে দ্বিগুণ হয়ে যায় তালেবান শক্তি।
জঙ্গি গোষ্ঠীটির তীব্র হামলায় খেই হারিয়ে ফেলে আফগান সেনা-পুলিশ। মৃত্যুভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি। ১৫ আগস্ট দখল করে নেয় কাবুল। শুরু হয় দ্বিতীয় মেয়াদের তালেবান যুগ।
জঙ্গিগোষ্ঠী থেকে এক লাফে সরকার। ভোল পালটে দলের কুখ্যাত নেতারা বনে যান মন্ত্রী-আমির, মেয়র-গভর্নর। গোষ্ঠীর মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা হয়ে ওঠেন পুলিশ-সেনাসদস্য-সেনাপ্রধান! হত্যা-খুন-অপহরণে সিদ্ধহস্ত নেতারাই এখন আফগানিস্তানের বিচারক। দেশের নীতিনির্ধারক।
আফগানিস্তাতে তালেবান সরকারে দ্বিবর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াহদাত (২২), মালং (২২), মোহাম্মদ খালেদ ও মোহাম্মদ লাল (২৩) তালেবানের উঠতি বয়সের দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ছিলেন। ক্ষমতা দখলের পর তারাই এখন পুলিশ। তাদের মতোই তালেবানের সব তরুণ জঙ্গিরাই এখন পুলিশ।
রাষ্ট্রশক্তির অংশীদার এ জঙ্গিরা এখন সুখে আছেন। এখন এর চেয়েও ঢের সুখের পেছনে ছুটছেন তারা। নতুন করে যুদ্ধ চান। নিজ দেশের সীমা ছাড়িয়ে এবার ভিন দেশে।
নিউইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে আলাপচারিতার একপর্যায়ে সেই ইচ্ছায় প্রকাশ করেন ওয়াহদাত। বলেন, ‘আমাদের শান্তি ও নিরাপত্তা সুরক্ষিত হয়েছে। তাই এখন আমাদের অন্য দেশে যুদ্ধ করতে হবে।’
এক সন্ধ্যায় কাবুলে তার বন্ধুদের সঙ্গে চা পান করতে করতে এ কথা বলেন। মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দেন বন্ধু মালংও। বলেন, ‘অন্য দেশেও আমাদের জিহাদ চালিয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।’
দুজনই বড় হয়েছেন মধ্য আফগানিস্তানের ওয়ারদাক প্রদেশে। যেখানে তালেবানদের পরিচালিত স্কুলগুলো পুরো প্রদেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। বদলে যায় তরুণপ্রজন্ম। পারিবারিক খামারে শ্রম না দিয়ে ঝুঁকে পড়েন জিহাদের দিকে।
ওয়ারদাকের বাসিন্দা আব্দুলবারী ওয়াসিল সরকার (৩৮) বলেন, আমাদের গ্রামটি আগে ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার তৈরির জন্য পরিচিত ছিল। আরও বলেন, এখন তরুণপ্রজন্ম শুধু জিহাদের দিকে আগ্রহী। ওই অঞ্চলের অনেক ছেলের মতোই ওয়াহদাত ও মালং কিশোর বয়সেই তালেবানে যোগ দেন।
২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর কাবুলের পুলিশ ইউনিটে নিযুক্ত করা হয়। তারা বলেন, তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) নামে পরিচিত একটি জঙ্গি গোষ্ঠীতে যোগ দিতে আগামী মাসে পাকিস্তানে যাবেন।
তরুণ লাল মোহাম্মদও ছিলেন তালেবানের দলে। তালেবান যোদ্ধা থেকে একজন পুলিশ অফিসারে নিযুক্ত হন লাল মোহাম্মদও। একই গল্প মোহাম্মদ খালেদ তাহিরেরও। ছোট বেলা থেকেই জিহাদ করার স্বপ্ন ছিল। বড় হতেই যোগ দেন তালেবানে। যুদ্ধের পরে একজন সৈনিক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে। তবে দেশে নয়, যোগ দেন সীমান্তের ওপারে পাকিস্তানে।
বলেন, আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য শহিদ হওয়া। সেখানে যাওয়ার এক মাস পর তিনি পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হন বলে জানান স্বজনরা। তাহেরের মতো অনেকে বলেন, তারা জিহাদ চালিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিশ্বের যেখানেই হোক না কেন।
প্রতিবেশী দেশগুলোতে তালেবানের সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি দীর্ঘকালের আশঙ্কাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে। রাশিয়া ও চীন থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান পর্যন্ত সব দেশেই আফগানিস্তানের আলকায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের মতো সন্ত্রসী গোষ্ঠীর সম্ভাব্য পুনরুত্থানের বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে।
পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, শত শত তরুণ তালেবান সৈন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য সরকারের অনুমতি ছাড়াই অবৈধভাবে পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে। তারা টিটিপিতে যোগ দেন। কঠোর ইসলামি শাসন জারি করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
ঠিক কতজন আফগান টিটিপিতে যোগ দিতে সীমান্ত অতিক্রম করেছেন তা জানা যায়নি। যোগ দেওয়া ব্যক্তিরা বছরের পর বছর ধরে তালেবান পরিচালিত শিক্ষার মাধ্যমে চালিত হয়।
সম্প্রতি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ আফগান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস গোষ্ঠীকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ করে। তবে তালেবান কর্মকর্তারা তা অস্বীকার করেন। গত সপ্তাহে আফগানিস্তানে অবস্থিত একটি ইসলামিক স্টেটের সহযোগী পাকিস্তানে আত্মঘাতী বিস্ফোরণ ঘটায়। ফলে অন্তত ৬০ জন নিহত হন।
তালেবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে ঘন ঘন হামলা বেড়েছে বলে জানা যায়। চরমপন্থি সহিংসতা নিরীক্ষণকারী ইলামাবাদ-ভিত্তিক পাক ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজ অনুসারে টিটিপি গত এক বছরে পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১২৩টি হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানের কর্মকর্তারা তালেবানদের সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির বলেন, আফগানিস্তান ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে তার দেশ শক্তি প্রয়োগ করবে। আরও বলেন, সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কগুলোকে ধ্বংস করতে ও তার নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে কোনো প্রচেষ্টাই তিনি ছাড়বেন না। যুগান্তর অবলম্বনে