জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ - ২০২৩
নিজস্ব প্রতিবেদক : শুধু মাছ উৎপাদনই নয়, খাদ্যমান অনুযায়ী মৎস্য সম্পদ উৎপাদন ও বহির্বিশ্বে রপ্তানির উপর গুরুত্ব দিয়ে মৎস্য খাতে উন্নয়ন করে যাচ্ছে সরকার বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।
সোমবার (২৪ জুলাই) সকালে মৎস্য অধিদপ্তরের অডিটোরিয়ামে 'নিরাপদ মাছে ভরবো দেশ, গড়বো স্মার্ট বাংলাদেশ' এই প্রতিপাদ্য নিয়ে ছয় দিন ব্যাপী জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২৩ উদযাপন উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন তিনি এসব কথা বলেন। ওই দিন সকাল আটটার দিকে জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউতে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে র্যালী বের করা হয়। র্যালীতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি সাইদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক শেখ আজগর নস্কর এবং মৎস্য সম্পদ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীরা অংশগ্রহণ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনার দূরদর্শী দিক- নির্দেশনায় বর্তমান সরকার কর্তৃক অভ্যন্তরীণ মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয় এবং সামুদ্রিক জলাশয়ের উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার জন্য সময়োপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, মাছ উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান ও প্রযুক্তিনির্ভর, অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের দৃঢ় প্রত্যয়ে এবারের জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ উদযাপন করা হয়।
মন্ত্রী আরো বলেন, ২০৪১ সালে মাছ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫ লাখ মেট্রিক টন, যা বর্তমান উৎপাদনের চেয়ে প্রায় ১ দশমিক ৮ গুণ বেশি। এই পরিমাণ মাছ উৎপাদন করতে হলে আমাদের খামার যান্ত্রিকীকরণের পাশাপাশি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অনুষঙ্গ অত্যাধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি মৎস্য চাষ এ ব্যবস্থাপনার প্রতিটি পর্যায়ে ব্যবহার করতে হবে। শুধু মাছের পর্যাপ্ত উৎপাদনই নয় বরং এসব মাছ যাতে মানবস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হয়। সে বিষয়টিও সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে। মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, জেলেদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, নিরাপদ মৎস্য উৎপাদন ও সর্বোত্তম উৎপাদনশীলতা নিশ্চিতকরণ, মৎস্য অভয়াশ্রম ও সংরক্ষিত এলাকা স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ, ইলিশ সম্পদের উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা, সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা বিকাশে সামুদ্রিক মাছের মজুদ নিরূপণ ও স্থায়িত্বশীল আহরণ, মাছের বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে মৎস্য ও মৎস্য পন্যের ভ্যালুচেইন উন্নয়ন,মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণে সহায়তা প্রদান, মৎস্য ও মৎস্যপণ্য রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণ করা হচ্ছে।সময়োপযোগী নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ, উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের সফল বাস্তবায়নের ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪৭ দশমিক ৫৯ লাখ মেট্রিক টন। যা ২০১০-১১ অর্থবছরের মোট উৎপাদনের (৩০ দশমিক ৬২ লাখ মেট্রিক টন) চেয়ে প্রায় ৫৫ শতাংশ বেশি। বর্তমানে মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণ ৬০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে বৃদ্ধি পেয়ে ৬৭ দশমিক ৮০ গ্রামে উন্নীত হয়েছে। দেশের মোট জিডিপি'র ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ এবং কৃষিজ জিডিপি'র ২২ দশমিক ১৪ শতাংশ মৎস্য উপখাতের অবদান। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৪ লাখ নারীসহ ১৯৫ লাখ তথা প্রায় ১২ শতাংশের অধিক মানুষ এ খাতের বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে।মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য আজ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও স্বীকৃতি পেয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার 'দ্যা স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২২ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ ৩য়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে ৫ম, ইলিশ উৎপাদনে ১ম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে ৪র্থ অবস্থানে রয়েছে।
তিনি বলেন, সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের মজুদ নিরুপণ, এ খাতে দক্ষ জনবল সৃষ্টি, যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন এবং গভীর সমুদ্রে মাছের মিশীল আহরণের মাধ্যমে সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনীতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকার বদ্ধ পরিকর। এই লক্ষ্যে সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থাপনা, জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উপকূলীয় জলাশয়ে মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া ও সীউইড চাষের উদ্যোগ গ্রহণসহ সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের টেকসই উন্নয়নে মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট একনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের সর্বোত্তম আহরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আরডি মীন। সন্ধানী' নামক গবেষণা ও জরিপ জাহাজের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে এ পর্যন্ত ৪৪টি সার্তে ক্রুজ পরিচালনা করা হয়েছে। এছাড়াও গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মৎস্য আহরণের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
মন্ত্রী বলেন, সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য 'সামুদ্রিক মৎস্য আইন, ২০২০, সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ নীতিমালা, ২০২২' এবং 'সামুদ্রিক মৎস্য নীতিমালা ২০২২' প্রণয়ন করা হয়েছে। সামুদ্রিক মৎস্য আইনের আওতায় প্রতিবছর ৬৫ দিন সমুদ্র ও উপকূলীয় জলায়তনে সকল ধরনের মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সামুদ্রিক মৎস্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করে মৎস্য আহরণ বাড়িয়ে বিদেশে রপ্তানি করা যেমন সম্ভব হবে তেমনি সুনীল অর্থনীতি বিকাশের মাধ্যমে উপকূলবর্তী জনসাধারণের জীবিকার মানোন্নয়নসহ দেশের সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, প্রকৃত জেলেদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র বিতরণ করা হয়েছে। তাছাড়া মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ সময়ে জেলেদের খাদ্য ও প্রণোদনা, বিকল্প কর্মসংস্থান গঠনের পাশাপাশি ১ লাখ ৫০ হাজার মৎস্যজীবীর ডাটাবেইজ হালনাগাদ করা হয়েছে। উপকূলীয় মৎস্য আহরণের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে ৫২ হাজার ৪৯৩ টি মৎস্যজীবী পরিবার সমন্বয়ে ৪৫০টি মৎস্যজীবী গ্রাম সংগঠিত করা হয়েছে। সমুদ্রগামী মৎস্য নৌযানগুলোকে যথাযথভাবে তদারকী, নিয়ন্ত্রণ এবং সার্ভিল্যান্স করার জন্য ডিজিটালাইজ করা হচ্ছে।
শ ম রেজাউল করিম বলেন, বর্তমানে বিশ্বের ৫২টিরও
অধিক দেশে বাংলাদেশ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে। এসব দেশের মধ্যে প্রধানত গলদা, বাগদা, হরিনাসহ বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি, স্বাদুপানির মাছ-রুই, কাতলা, মৃগেল, আইড়, টেংরা, বোয়াল, পাবদা, কৈ এবং সামুদ্রিক মাছের মধ্যে ভেটকি, দাতিনা, রূপচাঁদা, কাটল ফিস, কাঁকড়া, কুচিয়া রপ্তানি হয়ে থাকে। এছাড়াও শুঁটকি মাছ, মাছের আইশ এবং চিংড়ির খোলসও রপ্তানি হয়ে থাকে। বাংলাদেশ হতে রপ্তানিকৃত মৎস্যজাত পণ্যের প্রায় ৭০ শতাংশ ভ্যালু অ্যাডেড প্রোডাক্টস।
আন্তর্জাতিক বাজারে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন মৎস্য ও মৎস্যপণ্য রপ্তানির লক্ষ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় ৩টি বিশ্বমানের মাননিয়ন্ত্রণ পরীক্ষাগার স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ি রপ্তানি অব্যাহত রাখার জন্য চাষি পর্যায়ে রোগমুক্ত ও মানসম্পন্ন চিংড়ি পোনা সরবরাহ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কক্সবাজার, সাতক্ষীরা ও খুলনায় ৩টি পিসিআর ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মৎস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে নিষিদ্ধ এন্টিবায়োটিকসহ ক্ষতিকর রাসায়নিকের রেসিডিউ দূষণ মনিটরিংয়ের জন্য মৎস্য অধিদপ্তর প্রতিবছর ন্যাশনাল রেসিডিউ কন্ট্রোল প্ল্যান প্রণয়ন ও তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করছে। রপ্তানিযোগ্য মাছ ও চিংড়ির ভ্যালুচেইনের সকল পর্যায়ে ট্রেসেবিলিটি সিস্টেম কার্যকর করা হয়েছে। বর্তমান সরকার মৎস্য ও মৎস্য পণ্য (পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০২০ প্রণয়ন করেছে। ইতোমধ্যে বাগদা চিংড়ি "বাংলাদেশের বাগদা চিংড়ি' ভৌগোলিক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় তা নিজস্ব পরিচয়ে ও স্বকীয়তায় সারাবিশ্বে পরিচিতি লাভ করছে। চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক বাজার বিবেচনায় দেশে চলতি বছর থেকে চাষি পর্যায়ে ভেনামি চিংড়ি চাষের অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। বর্তমান সরকারের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের ফলে বিশ্ববাজারে আর্থিক মন্দাবস্থা থাকা সত্বেও ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৭০ হাজার মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে আয় হয়েছে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। সরকারের কঠোর নজরদারির কারণে মাছ বাজারগুলো ফরমালিন মুক্ত হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক জলাশয়ে দূষণ প্রতিরোধ করতে হবে। সরকারি দপ্তর-সংস্থা এ লক্ষ্যে কাজ করছে। এ বিষয়ে জনসাধারণকেও সচেতন হওয়ার আহবান জানান মন্ত্রী।
###