বছরে শতাধিক দূর্ঘটনা
এক হতভাগার লাশ পড়ে আছে ফ্রিজে
নিজস্ব প্রতিবেদক: বুড়িগঙ্গা নদীতে খেয়া পারাপারের যাত্রীবাহী নৌকা,ট্রলার ও নৌযানের উপর একের পর এক বালু বোঝাই বাল্কেহেড চালিয়ে দিয়ে নিরীহ যাত্রীদের হত্যা করা হচ্ছে। সন্ধ্যার পর মালবাহী বাল্কহেড চালানোর উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অদৃশ্য কারণে বছরের পর বছর টাকা কার্যকর হচ্ছে না। বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় বছরে অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে। তাছাড়া বুড়িগঙ্গা নদীর ঢাকা নদী বন্দর এলাকায় বহিনোঙ্গরের সকল নৌযান সরিয়ে চ্যানেলটি ক্লিয়ার রাখার জন্য নির্দেশনা থাকলেও তা আমলে নেয়া হচ্ছে না।
জানা গেছে, দীর্ঘ দিন ধরে বুড়িগঙ্গা নদীর ঢাকা নদী বন্দর এলাকায় নৌ চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে । অবৈধ ট্রলার ও বালুবাহী বাল্কহেডের বেপরোয়া ধাক্কায় বছরে কয়েক শত ছোট বড় নৌ দূর্ঘটনা ঘটছে। ওইসব ঘটনায় গত ১বছরে অন্তত ৩০ব্যাক্তির মৃত্যু হয়েছে। নিখোঁজের তালিকাও দীর্ঘ।
রোববার রাতে ভয়ঙ্কর ওয়াটার বাস ডুবিতে তিনটি তরতাজা প্রাণ ঝরে গেছে। রাত দেড়টায় মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে দুই জনের পরিবার লাশ বুঝে নিলেও এক হতভাগ্য ব্যাক্তির লাশ হাসপাতালের ফ্রিজে পড়ে আছে। সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অজ্ঞতা ওই ব্যাক্তিকে কেউ চিহ্নিত করতে পারেনি। এরআগে গত ৩ আগস্ট রাতে কেরানীগঞ্জের মান্দাইল এলাকার আরমান মিয়া পরিবার ও আত্মীয়স্বজন নিয়ে নদীতে ঘুরতে বের হন। বসীলা থেকে বরিশুর যাওয়ার পথে বিপরীত দিক থেকে আসা বালুবাহী বাল্কহেড এম একতা ধাক্কা দিলে সঙ্গে সঙ্গে ট্রলার ডুবে যায়। ওই সময় ট্রলারটিতে নারী পুরুষ মিলে ২৩ জন যাত্রী ছিল। ২১ জন যাত্রী সাঁতরে কূলে উঠতে পারলেও শিশু ইশামণি (১০) ও ইসরাত (১২) নিখোঁজ ছিল। পরের দিন ওই দুই শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই বাল্কহেডটি আটক করার পরে মোটা অঙ্কের বাণিজ্য করে সদরঘাট নৌ থানা পুলিশ। এদিকে গত ২ এপ্রিল বুড়িগঙ্গায় একটি বাল্কহেড যাত্রীবাহী ট্রলারকে ধাক্কা দিলে সেটি অর্ধশতাধিক যাত্রীসহ ডুবে যায়। উদ্ধার করা হয় ১১ জনের লাশ। তিনজন রয়েছে নিখোঁজের তালিকায়।
অন্যদিকে ২০১৩ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চডুবে ১৪ জন নিহত হয়। এ ঘটনার পর রাতে বালুবাহী নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ করে সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর। দূর্ঘটনা কমাতে রাতের বেলায় বাল্কহেড চলাচল নিষিদ্ধ করা হলেও নৌপুলিশকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে রাতের বেলায় আরো বেপরোয়াভাবে এসব নৌযান চলাচল করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু বুড়িগঙ্গাই নয়, সারা দেশে বালু ব্যাবসাকে কেন্দ্র প্রায় দশ সহস্রাধিক বাল্কহেড চলাচল করছে। ওইসব বাল্কহেডের অধিকাংশই অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছে। বিশেষ করে তিন শত টনের নীছে অধিকাংশ কার্গো ও বাল্কহেডের অনুমোদনই নেয়া হয়নি। আবার যেসব বাল্কহেডের রেজিষ্টেশন ( এম) নম্বর রয়েছে; এ ধরনের নৌযানগুলোর অধিকাংশই সার্ভে মেয়াদ উর্তীর্ণ। তাছাড়া ওইসব নৌযান নির্ধারিত গ্রেডের মাষ্টার ও ড্রাইভার দিয়েও পরিচালনা করা হয়না। এসব নৌযানের ধাক্কায় পাঁচ বছরে অন্তত দেড় শতাধিক মানুষের করুন মৃত্যু ও দেড় হাজার মানুষ আহত হয়েছে বলে একটি সূত্র দাবি করেছে। বিশেষ করে সরকারী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাতের বেলায় বেপরোয়া বাল্ক হেড চলাচল করায় দুর্ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। তাছাড়া দূর্ঘটনায় দায়ী নৌযানের মালিক চালকদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও সাজার নজিরও খুব কম। অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও অদক্ষ চালক দিয়ে নৌযান পরিচালনা করায় দূর্ঘটনা বেড়েছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
সূত্র বলছে, বুড়িগঙ্গা নদীর ফতুল্লা থেকে আমীন বাজার পর্যন্ত ৪২টি খেয়াঘাটে কয়েক হাজার ডিঙ্গি নৌকা চলাচল করছে। বাল্কহেডের বেপরোয়া চলাচলের কারনে ওইসব খেয়াঘাট দিয়ে প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ নদী পারাপার হচ্ছে।
মূলত খেয়া পারাপার নৌকাগুলোই বেশি দূর্ঘটনার কবলে পড়ছে। এর মধ্যে পোস্তগোলা থেকে বসিলা ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ থেকে সাত হাজার খেয়া নৌকায় প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ পারাপার হয়। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই শ্রমিক। তারা সদরঘাট, মিটফোর্ড ও বাদামতলী ছাড়াও পুরান ঢাকার বিভিন্ন কলকারখানায় কর্মরত। ভোর ৪টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত নৌকা পারাপারে ভিড় থাকে। সন্ধ্যা হতেই তা স্রোতে রূপ নেয়। প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় সহাস্রাধিক বাল্কহেড চলাচল করছে। সন্ধ্যার পর এসব নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও তা মানছে না বাল্কহেড চালক ও মালিকরা। তারা নিয়মিত নৌপুলিশকে চাঁদা দিয়ে নিষিদ্ধ সময়ে চলাচল করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশ লঞ্চ শ্রমিক ও বাল্কহেড শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম জানান, নদীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবৈধ বাল্কহেড। এ কথা সত্য। তবে নৌযান কেন্দ্রিক সরকারি অধিদফতর পরিদফতর ছাড়াও নৌপুলিশের খোরাক এই বাল্কহেভ দিয়ে। আগে চাঁদপুর থেকে সাভার আমিনবাজার পর্যন্ত চাঁদা দিতে হতো তিন হাজার ৬০০ টাকা। বর্তমানে প্রতি বাল্কহেডে আপডাউন খরচ ৩৬ হাজার টাকা। তারপরে সন্ধ্যা ৬টার পর চলাচল করলে খরচ আরো বেশি হয়।
বুড়িগঙ্গায় খেয়াপারাপার কয়েকজন মাঝি এ প্রতিবেদককে জানায়, বুড়িগঙ্গায় হাজার মাঝি ও নৌকা। চোখের সামনে দেখেও সহসা গতি কমায় না বাল্কহেড চালকরা। ওইসব নৌযানের ধাক্কায় প্রতিদিন দুই থেকে চারটি খেয়া নৌকা ডুবে যায়। প্রায়ই কেউ না কেউ মারা যায়। নৌপুলিশ এসব দেখেও না দেখার ভান করে।
নৌ অধিদপ্তরের একটি সূত্র বলছে, নৌপথের মূর্তিমান যমদূত বালুবাহী কার্গো বা বাল্কহেড। ফিটনেস, লাইসেন্স, দক্ষ চালক কিছুই নেই তাদের। তবুও রাত-দিন নৌপথে চলছে বাল্কহেড। আর অবলীলায় ঘটাচ্ছে একের পর এক দুর্ঘটনা। সরকারি হিসাবে তিন হাজার ৮১১টি বালুবাহী বাল্কহেড নিবন্ধিত থাকলেও বেসরকারি গবেষকদের মতে এর সংখ্যা কমপক্ষে ১০ হাজার। অর্থাৎ নিবন্ধিত সংখ্যার চেয়ে প্রায় তিনগুণ অবৈধ বাল্কহেড চলছে নদীপথে। সন্ধ্যার পর বাল্কহেডগুলো নদীপথের জন্য আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। কারণ লাইটবিহীন বাল্কহেডের বেশির ভাগ অংশই পানির নিচে থাকায় ২০ হাত দূর থেকেও তা চোখে পড়ে না। আর দুর্ঘটনা ঘটেছে নিত্য।
এ বিষয়ে ঢাকা নদী বন্দরের যুগ্ন পরিচালক ( ট্রাফিক)মোঃ কবীর হোসেন ঙবলেন, সন্ধ্যার পরে কোনো বাল্কহেড বুড়িগঙ্গায় চলাচল করা অবৈধ। সঠিক তদারকির অভাবের কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, রোববার দুর্ঘটনায় গঠিত জাহাজটি দিয়ে সরকারি অন্য একটি সংস্থা এবং অন্য ঘাট থেকে চলাচল করায় আমাদের তেমন কোন তদারকি ছিল না। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ওই জাহাজটি সরকারি অন্য একটি সংস্থার মালিকানাধীন। বিআইডব্লিউটিএ থেকে তারা কোন টাইম টেবিল নেননি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
অবৈধ বাল্কহেডের বিষয়ে নৌ-পরিবহন অধিদপ্তরের চীপ ইঞ্জিনিয়ার ও প্রধান শিপ সার্ভেয়ার মোঃ মঞ্জুরুল কাদেরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
এদিকে রোববার রাতে যাত্রীবাহী ওয়াটার বাস এম এল ধরলাকে ধাক্কা দেয়া বাল্কহেড এম ভি তিশা -৫, এমএল ১৩৬৪৫ নামক বাল্কহেড ও এর চার কর্মচারীকে আটক করেছে সদরঘাট নৌথানা পুলিশ। তারা হলেন- মাস্টার: মোঃ শরিফুল ইসলাম (৩৫), ড্রাইভার মোঃ আনছার আলী (৩৭), সুকানী মোঃ সজীব সরদার (২৭) ও লস্কর মোঃ সিয়াম বেপারী (২০)। তাদের বিরুদ্ধে দক্ষিন কেরানীগঞ্জ থানায় নিয়মিত মামলা করা হয়েছে। আসামীদের আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে প্রেরন করা হয়েছে। দুর্ঘটনা কবলিত নৌযান
এম এল ধরলাকে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম সোমবার ভোর রাতে টেনে তুলেছে। ওই সময় নৌযানটিতে কোন মরদেহ পাওয়া যায়নি।