মুফতী মুহাম্মদ আমীর হুসাইন : প্রায় ৫ হাজার বছর পূর্বে মহান আল্লাহর নবী হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম ও তাঁর আদরের পুত্র ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর আল্লাহর প্রতি নিবেদনের এক অগ্নিপরীক্ষায় জয়ের মাধ্যমে পশু কোরবানির বিধান প্রবর্তিত হয়। পবিত্র কুরআনুল কারীমে মহান আল্লাহ এ ঘটনা বিস্তারিত বর্ণনা করেন। সামর্থবান মুসলিম নর নরীর জন্য অবশ্য পালনীয় বিধানটি কুরআন ও হাদীসের আলোকে এর মহত্মগুলো আনুধাবন ও বাস্তবজীবনে অনুকরন করতে পারলে কুরবানীর হক আদায় হবে। ঈদুল আযহা তথা কোরবানী মুসলিম উম্মাহ নিজেদের ভিতর ঐক্য সম্প্রীতি বন্ধনকে দৃঢ় করে। পাশাপাশি কুরবানী দাতা তার চরিত্র ও মানসিকতার কু-পুরি বা দোষনীয় গুণ ( লোভ ক্ষোভ, হিংসা, অহংকার, পরনিন্দা, চোগলখুরী, ব্যাবিচার, মানুষের হক বিনস্ট) দমন করে পরিশুদ্ধ মানবিকতার উদার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। যারা নবী ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের সুন্নত অনুযায়ী আল্লাহর প্রেমে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণের লক্ষ্য নিয়ে কোরবানি করবে, তাদের জন্য উত্তম পুরস্কার রয়েছে।
রাসুল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন পশুর লহু জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহ তাআলার নিকট
কুরবানী কবুল হয়ে যায়।
আল্লাহ তা’আলা মুমিন, মুসলমানকে দুটি উৎসব দান করেছেন। তন্মধ্যে একটি হচ্ছে, ঈদুল ফিতর। আরেকটি হল ঈদুল আযহা অর্থাৎ কুরবানী। কুরবানী করার দ্বারা কুরবানী দাতার মধ্যে ফুটে ওঠে মহান মালিকের প্রতি ব্যাকুলতাপূর্ণ ভালোবাসার তৃব্রতা। আবেগে আপ্লুত, নির্মল আত্মার আত্মপ্রকাশ ঘটে। তাছাড়া কোরবানি নবী ইব্রাহিম (আঃ) এর সুন্নত যিন্দা করার অনুশীলন, অনুকরণ। ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে কোরবানি শুধু উৎসবে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তাতে রয়েছে সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার দেয়া নেয়ামত রাজির কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ।
কোরবানি জিনিসটি কী? তা প্রচলিতভাবে অনেকের জানা-শোনা থাকলেও; অনেক মানুষ আছে, কোরবানীর মূলতত্ত্ব সম্পর্কে অনবহিত, বে-খবর। ফার্সী, উর্দু, বাংলা ভাষায় তা “কোরবানী” শব্দে ব্যক্ত করা হয়। আরবী ভাষায় সেটি “কোরবান” শব্দে ব্যবহৃত হয়। যার শাব্দিক অর্থ হলো নৈকট্য। শরঈ আলোকে কুরবানী বলা হয়: ১০-ই যিলহজ্জ সুবহে সাদেক থেকে ১২ই যিলহজ্জ সূর্য অস্ত যাওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বান্দাহ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হালাল চতুষ্পদ প্রাণী তথা- উট, গরু, মহিষ, ভেড়া, দুম্বা ও ছাগল জবাই করে পরিবার,আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের মাঝে বিলিয়ে দেয়। মহান আল্লাহ তা’য়ালা বান্দার কল্যাণার্থে এই কোরবানির বিধানটি পালনের প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন।
কুরআনুল কারীমের মধ্যে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
فصل لربك وانحر
(তরজমা) অতএব আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন। এ আয়াতের মধ্যে نحر (নহর )শব্দটির অর্থ নিয়ে যদিও বিভিন্নজন বিভিন্ন ধরনের প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে থাকে। কিন্তু নহরের বিশুদ্ধতম ও নির্ভরযোগ্য ব্যাখ্যা হলো: কোরবানি।
মুফাসসির ইবনে কাসীর রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাফসীর ইবনে কাসীরের ৮ নাম্বার খণ্ডের ৫০৭ নং পৃষ্ঠায় উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন-
والصحيح القول الأول ، أن المراد بالنحر ذبح المناسك
(প্রথম মতটিই বিশুদ্ধতম মত অর্থাৎ নহর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কুরবানীর পশু জবাই করা।)
আল্লাহ তা’আলা উক্ত আয়াতে আমাদেরকে দুটি বিষয়ের নির্দেশ করেছেন। অর্থাৎ নামাজ এবং কোরবানির। নামাজ হচ্ছে শারীরিক এবাদতসমূহের মাঝে সর্ববৃহৎ এবাদত। আর কুরবানী হচ্ছে আর্থিক ইবাদত সমূহের মধ্য হতে বিশেষ স্বতন্ত্র ও গুরুত্বের অধিকারী ইবাদত। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল আযহার দিন ঈদের নামাজ আদায় করে তিনি নিজের কোরবানির পশু জবাই করেছেন। এমনকি তিনি ইন্তেকালের পূর্বেও হযরত আলী রাঃ কে অসিহত করে গিয়েছেন যে, তিনি যেন তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করেন। এ কারণে হযরত আলী রাঃ প্রতিবছর রসূল সাঃ এর পক্ষ থেকে কুরবানী করতেন।
হানাশ রহ. বলেন-
رَأَيْتُ عَلِيّا يُضَحِّي بِكَبْشَيْنِ، فَقُلْتُ مَا هَذَا؟ فَقَالَ: إِنّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَوْصَانِي أَنْ أُضَحِّيَ عَنْهُ فَأَنَا أُضَحِّي عَنْهُ.
আমি আলী রা: কে দেখলাম; দুটি দুম্বা কুরবানী করছেন। আমি বললাম, এটি কী হচ্ছে? তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ওসীয়ত করেছেন, তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করতে। তাই আমি তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করছি।
(মুসনাদে আহমাদ, হাদীস: ১২৮৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস: ২৭৯০; তিরমিযী শরীফ, হাদীস: ১৪৯৫;)
আল্লাহ তাআলা রাসূলকে সম্বোধন করে কুরআনুল কারিমের অন্যত্র বলেন-
قل ان صلاتى ونسكى ومحياى ومماتى لله رب العالمين.
(তরজমা) (আপনি বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ অর্থাৎ আমার সবকিছু আল্লাহ রাববুল আলামীনের জন্য উৎসর্গিত।
(সূরা আনআম : ১৬২)
এই আয়াতের মধ্যে ‘নুসুক’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কোরবানি। যা মুফাসসিরগণ তাফসীরের কিতাবসমূহে বিষয়টি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন।
হাদীস শরীফে এসেছে-
হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন দু’টি দুম্বা যবেহ করেছেন। যবেহ কালীন সময়ে তিনি বলেছেন-
اِنِّیْ وَجَّهْتُ وَجْهِیَ لِلَّذِیْ فَطَرَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ حَنِیْفًا وَّ مَاۤ اَنَا مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ لَا شَرِیْكَ لَهٗ ۚ وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِیْنَ ، بِسْمِ اللهِ وَاللهُ أَكْبرُ، اَللّهُمَّ مِنْكَ وَلَكَ عَنْ مُحَمَّدٍ وَّأُمَّتِهِ.
(অর্থ:) আমি সম্পূর্ণ একনিষ্ঠভাবে সেই সত্তার দিকে নিজের মুখ ফেরালাম যিনি আকাশমনণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং আমি শিরক কারীদের অন্তর্ভুক্ত নই। আপনি বলুন, নিঃসন্দেহে আমার নামাজ, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ (সবকিছুই) রব্বুল আলামীন আল্লাহর জন্য। তাঁর কোনো শরীক নেই। আমাকে এই আদেশই করা হয়েছে, সুতরাং আমি হলাম প্রথম আত্মসমর্পণকারী।’ ‘আল্লাহর নামে। আর আল্লাহ সবচেয়ে বড়। ইয়া আল্লাহ! তোমার নিকট থেকে এবং তোমার উদ্দেশ্যে। ইয়া আল্লাহ! মুহাম্মাদ ও তার উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করুন।
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীস থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয় যে, সামর্থ্যবানদের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কুরবানী করা আবশ্যক। এ সঙ্গে কুরবানীদাতা কেমন এখলাসপূর্ণ মন নিয়ে কোরবানি করবে; সেটিও প্রতীয়মান হয়।
যে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আদেশকে উপেক্ষা করে, অমান্য করে; সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী আদায় করে না তার ব্যাপারে হাদীস শরীফে কঠোর ধমকি এসেছে।
عن أبي هريرة قال : قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : من وجد سعة لأن يضحي فلم يضح فلا يقربن مصلانا.
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যার কুরবানীর সামর্থ্য আছে তবুও সে কুরবানী করল না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।
(মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস : ৩৪৬৮; মুসনাদে আহমদ, হাদীস: ৮২৭৩; আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব ২/১৫৫)
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-
عن زيد بن أرقم، قال: قال أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم: يا رسول الله ما هذه الأضاحي؟ قال: «سنة أبيكم إبراهيم» قالوا: فما لنا فيها يا رسول الله؟ قال: «بكل شعرة، حسنة» قالوا: ” فالصوف؟ يا رسول الله قال: «بكل شعرة من الصوف، حسنة»
হযরত যায়েদ বিন আরকাম রা: বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই কুরবানী কি? তিনি বললেন, তোমাদের পিতা ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের সুন্নত। তারা বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! তাতে আমাদের জন্য কী সাওয়াব রয়েছে? তিনি বললেন, প্রত্যেক পশমের বিনিময় একটি করে নেকী রয়েছে। তারা বললেন, তিনি বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! ভেড়ার পশমের বিনিময়েও কি? তিনি বললেন, ভেড়ার প্রত্যেক পশমের বিনিময়ে একটি নেকী রয়েছে।
(মুসনাদে আহমাদ; হাদীস: ১৯২৮৩; আত তারগীব ওয়াত তারহীব: ২/১৫৯ ; হাদীস: সুনান ইবনে মাজাহ; হাদীস: ৩১২৭ )
অপর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ السَّيِّدَةِ عَائِشَةَ رضي الله عنها أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «ما عَمِلَ آدَمِيٌّ من عملٍ يومَ النَّحْرِ، أحَبَّ إلى اللهِ من إهراقِ الدَّمِ إنها لَتَأْتِي يومَ القيامةِ بقُرُونِها، وأشعارِها، وأظلافِها، وإنّ الدَّمَ لَيَقَعُ من اللهِ بمَكانٍ، قبلَ أن يقعَ على الأرضِ، فَطِيبُوا بها نَفْسًا».
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কুরবানীর দিনের আমলসমূহের মধ্য থেকে পশু কুরবানী করার চেয়ে কোনো আমল আল্লাহ তাআলার নিকট অধিক প্রিয় নয়। কিয়ামতের দিন এই কুরবানীর পশু তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ উপস্থিত হবে। আর কুরবানীর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহ তাআলার নিকট কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা খুশি-মনে কুরবানী কর।
( তিরমিযী শরীফ, হাদীস : ১৪৯৩; সুনান ইবনে মাজাহ, হাদীস: ৩১২৬)।
লেখক : জামিয়া মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার মুহাদ্দিস ও ফাতেমা বায়তুল আকসা জামে মসজিদের ইমাম ও খতীব, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ঢাকা