বাংলামেইল৭১ ডেস্ক : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতিতে চলছে নানামুখী তৎপরতা। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। শিগগিরই রাজনৈতিক সংকট নিরসনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য দলও নিজেদের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। ছোট ছোট দল মিলে নতুন জোট গঠনেও চলছে নানা তৎপরতা। কোনো পক্ষের ইন্ধনে নিজেদের ‘তৃতীয় শক্তি’ হিসাবে জানান দিতে চাচ্ছে। এর অংশ হিসাবে মঙ্গলবার রাজধানীর মালিবাগের স্কাই সিটি হোটেলে ১৯টি রাজনৈতিক দল নিয়ে ‘গোপন’ বৈঠক করে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপির সভাপতি ক্বারি মো. আবু তাহের। হঠাৎ করে তার এমন ভূমিকা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে নানা কৌতূহল। পর্দার আড়ালে চলছে তোলপাড়। বিশেষ করে এনডিপি বিএনপির সমমনা হওয়ায় তাদের এ উদ্যোগকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। বিএনপির হাইকমান্ডও এ ব্যাপারে খোঁজখবর শুরু করেছেন। বৈঠকে অংশ নেওয়া দলগুলোর কর্মকাণ্ডের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা রয়েছে কিনা সেদিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপির হাইকমান্ড। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।
ইতোমধ্যে বৈঠকে অংশ নেওয়া সমমনা দল ও জোটের শরিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। কেন তারা সেখানে গিয়েছিলেন তা জানার চেষ্টা করছেন। বৈঠকে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ দলের নেতারা জানান, এ সম্পর্কে তারা আগে অবহিত ছিলেন না। নৈশভোজের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়েছেন। যাওয়ার পরে অচেনা কয়েকজন ব্যক্তির তৎপরতায় তাদের সন্দেহ হয়। এনডিপির সভাপতির বক্তব্যে তা স্পষ্ট হয়। শুধু নৈশভোজ নয়, এর পেছনে রাজনৈতিক সুদূরপ্রসারী মিশন রয়েছে।
উল্লেখ্য, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক ছিল এনডিপি। পরে তা ভেঙে ১২ দলীয় জোট গঠন করা হয়। সেই জোটেও রয়েছে এ দলটি। বিএনপির নেতৃত্বে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় রয়েছে ১২ দলীয় জোট।
এ প্রসঙ্গে এনডিপির সভাপতি ক্বারি মো. আবু তাহের যুগান্তরকে বলেন, বৈঠকটি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে হয়েছে। কোনো ষড়যন্ত্র করা হয়নি। সেখানে গণঅধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, জাগপা, গণফোরাম (একাংশ), জাস্টিস পার্টি, পিপলস পার্টি, লেবার পার্টি, মুসলিম লীগসহ ১৯টি দল ছিল।’
হঠাৎ কেন এমন উদ্যোগ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা চিন্তা করছি যদি কোনো একটি মিডেল গভর্মেন্ট আসে, তাহলে স্বাভাবিকভাবে সেখানে অবশ্যই মাইনাস টু ফর্মুলা হয়ে যাবে। এগুলো আমরা বুঝতে পারছি। দেশের যে পরিস্থিতি তা হলো একদিকে সরকার, অন্যদিকে বাকি সবাই। দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। যদি একসঙ্গে করতে হয় তাহলে অবশ্যই মিডেলে কিছু অবস্থান করতে হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় সরকার প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।’
আবু তাহের আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরবিরোধী অবস্থানে। কেউ কাউকে দেখতে পারে না। দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার কারণেই ওয়ান-ইলেভেন সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা চাচ্ছি মানুষদের ক্ষতিগ্রস্ত না করে যদি একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করা যায়।’ ৩৫ থেকে ৪০টি দল নিয়ে একটি জোট গঠনের চেষ্টা হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এজন্য প্রয়োজনে ১২ দলীয় জোট ছেড়েও দিতে পারি।
জানা গেছে, বৈঠকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল বাদে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলকে নৈশভোজসহ আমন্ত্রণ জানানো হয়। তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ দেখা দিলে আমন্ত্রিত অধিকাংশ দল অংশ নেয়নি। একটি অভিজাত হোটেলে এনডিপির মতো দলের এমন বড় আয়োজন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিএনপিসহ সমমনা জোটগুলোও। এ নিয়ে দু-একদিনের মধ্যে ১২ দলীয় জোটের সভা ডাকা হতে পারে। এমন তৎপরতার জন্য জোট থেকে এনডিপিকে বাদ দেওয়ারও সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
সোমবার থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে মোবাইলে এসএমএস ও ফোন করে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এনডিপির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘দেশের রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যৎ পরিস্থিতির সম্ভাব্যতার আলোকে করণীয় ও পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা সভা ও নৈশভোজের আয়োজন করা হয়েছে।’
সূত্র জানায়, আমন্ত্রণ পেয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটসহ আন্দোলনে থাকা দলগুলোর শীর্ষ নেতারা বিএনপির কয়েক নীতিনির্ধারককে অবহিত করেন। বিএনপি নেতারা বৈঠক পর্যবেক্ষণে ১২ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে একটি দলকেও পাঠান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক যুগান্তরকে জানান, এনডিপিসহ কয়েকটি দলের তৎপরতা আগে থেকে তারা পর্যবেক্ষণ করছেন। মালিবাগের বৈঠকটি সন্দেহজনক। এর পেছনে কারা এবং এত বড় আয়োজনের অর্থের উৎস সম্পর্কেও জানার চেষ্টা করছেন। তবে গণঅধিকার পরিষদ, কল্যাণ পার্টি, গণফোরাম (একাংশ), লেবার পার্টিসহ আরও দু-একটি দল বৈঠকের উদ্দেশ্য না জেনেই অংশ নিয়েছেন বলে তারা জানতে পেরেছেন। এমন আয়োজনের কথা ওই দলগুলো আগে থেকে জানত না। তারা শুধু প্রতিনিধি পাঠায়।
জানতে চাইলে ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম যুগান্তরকে বলেন, ‘এ বৈঠকে ২৭ বা ৭ দল বা অন্য কোনো দলের সঙ্গে ১২ দলীয় জোটের পক্ষে আলোচনার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মালিবাগে এনডিপির সভাপতির নিজস্ব দাওয়াত ছিল। কল্যাণ পার্টির প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু বৈঠক বা উদ্দেশ্য সম্পর্কে দল জানত না।’
গণঅধিকার পরিষদের সদস্য সচিব নুরুল হক নূর বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে কেউ যেতে পারে। আমাকেও বলা হয়েছিল, যারা সরকারবিরোধী আন্দোলন করছে-এ রকম কিছু লোকজন থাকবে। একটি নৈশভোজ আয়োজন করেছে। আমি বলেছি এ রকম প্রোগ্রামে থাকা যাবে না। বিশেষ করে দলীয় পর্যায় থেকে সমস্যা আছে। এর বাইরে আর কিছু আমার জানা নেই। সে রকম কোনো রাজনৈতিক জায়গা থেকে তার দল কিংবা তার কোনো উদ্যোগ গুরুত্ব বহন করে বলে আমার মনে হয় না।’
বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘আমরা জোটবদ্ধভাবে আন্দোলন করছি। রাজনৈতিক কোনো কিছু চিন্তাভাবনা বা কোনো কিছু বিচার-বিশ্লেষণ করতে গেলেও তো হয় নিজের দলের কিংবা জোটে আলোচনা করব। বর্তমান সময়ে এ ধরনের বৈঠকের আয়োজন করাটা রহস্যজনক। এটা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রমূলক হতে পারে।’
বৈঠকে অংশ নেওয়া গণফোরামের একাংশের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, অন্য কিছু জানতাম না। নৈশভোজের আমন্ত্রণ পেয়ে গিয়েছিলাম। লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, আমরা কীভাবে আন্দোলন জোরদার করতে পারি বৈঠকে সেই আলোচনাই হয়েছে। অন্য কিছু শুনিনি। সূত্র- যুগান্তর