বাংলামেইল৭১ ডেস্ক : অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জালে আটকা পড়লেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আবদুল হাই বাচ্চু। তিনি বেসিক ব্যংকের ভয়াবহ ঋণ কেলেঙ্কারির হোতা এবং প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান। মামলা দায়েরের আট বছর পর শেষ পর্যন্ত ফেঁসে গেলেন বাচ্চুসহ ১৪৭ জন। তাদের অভিযুক্ত করে একযোগে ৫৯ মামলার চার্জশিট দিয়েছে সংস্থাটি। আসামিদের বিরুদ্ধে ২ হাজার ২৬৫ কোটি ৬৮ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। সোমবার কমিশন বৈঠকে এই চার্জশিট অনুমোদনের পর তা আদালতে দাখিল করা হয়। দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা জানান, চার্জশিটে নাম যুক্ত হওয়ার পর আইন অনুযায়ী তাকে গ্রেফতারে আর কোনো বাধা নেই। দুদক ছাড়াও আদালতের নির্দেশে পুলিশও তাকে গ্রেফতার করতে পারে। তবে তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত করে কোনো তথ্য দিতে পারেনি কেউ।
জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের গুলশান, দিলকুশা ও শান্তিনগর শাখা থেকে মোট সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়। ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠলে তা অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। অনুসন্ধানকালে দুদক কর্মকর্তারা জানতে পারেন ব্যাংকটির পরিচালনা পর্যদ ঋণপত্র যাচাই না করে ভুয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। জামানত ছাড়া এবং জাল দলিল মর্টগেজ রেখে বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ অনুমোদন করেন তারা। দীর্ঘ পাঁচ বছর অনুসন্ধান চলাকালে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এরপর কমিশনের অনুমোদন নিয়ে ২০১৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর তিন দিনে ৫৬টি মামলা দায়ের করা হয়। রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন ও গুলশান থানায় দায়ের করা এসব মামলায় মোট ১২০ জনকে আসামি করা হয়। আসামির তালিকায় ৮২ ঋণগ্রহীতা, ২৭ ব্যাংকার ও ১১ জন ভূমি জরিপকারীর নাম থাকলেও ছিল না ঋণ কেলেঙ্কারির মূলহোতা আব্দুল হাই বাচ্চুর নাম। কিন্তু মামলার তদন্তকালে দুদক জানতে পারে আলোচিত এই ঋণ কেলেঙ্কারির পেছনে কলকাঠি নেড়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চু। এ কারণে বাচ্চুসহ আরও বেশ কয়েকজনের নাম চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
চার্জশিট অনুমোদনের বিষয়টি জানাতে সোমবার দুপুরে দুদক কার্যালয়ে সংবাদ ব্রিফিংয়ে সংস্থার সচিব মো. মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, দুদকের ৫ জন তদন্ত কর্মকর্তা মামলাগুলোর তদন্ত শেষে তারা চার্জশিট দাখিলের সুপারিশসহ কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন। কমিশন সোমবার ৫৯টি মামলার দাখিলকৃত প্রতিবেদন অনুমোদন দেওয়ার পর সোমবারই আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। তাতে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান বাচ্চুসহ ১৪৭ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
দুদক সচিব আরও বলেন, বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা ও ঋণগ্রহীতা বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান যোগসাজশ করে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছেন। এই ৫৯ মামলার তদন্ত করেছেন সংস্থাটির পরিচালক মোহাম্মদ মোরশেদ আলম, উপপরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহীম, মো. মোনায়েম হোসেন, মোহাম্মদ সিরাজুল হক ও মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান।
জানা গেছে, ব্যাংকার ও ঋণগ্রহীতাদের অনেকেই একাধিক মামলায় আসামি করা হলেও আব্দুল হাই বাচ্চু ছিলেন অধরা। তাকে কোনো মামলায়ই আসামি করা হয়নি। এ বিষয়ে বরাবরই দুদকের বক্তব্য ছিল, ‘ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দালিলিকভাবে আব্দুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।’ একই সঙ্গে রহস্যজনক কারণে মামলার তদন্ত আটকে ছিল। এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ আদালত একাধিকবার অসন্তোষ জানালে পালটে যায় সবকিছু। সোমবার একযোগে দাখিল করা হয়েছে ৫৯ মামলার চার্জশিট। অভিযুক্ত করা হয়েছে বাচ্চুকেও।
বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে আবদুল হাই বাচ্চু বলেছিলেন, ‘আমি যা করেছি সরল মনে করেছি। অনেক ক্ষেত্রে ভুল হয়েছে। তবে সব দায় আমার নয়। কারণ বোর্ডের অনুমোদনের বাইরে আমি কিছুই করিনি।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার্জশিটে অভিযুক্ত হওয়ার পর আইনের চোখে এখন ফেরার দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আব্দুল হাই বাচ্চু। তাকে গ্রেফতারেও কোনো বাধা নেই। কিন্তু তার অবস্থান এখন কোথায় সে ব্যাপারে কোনো তথ্য নেই তদন্ত সংস্থার কাছে। তবে আদালত চাইলে এ ব্যাপারে পুলিশকে নির্দেশ দিয়ে তাকে গ্রেফতারের ব্যবস্থা করতে পারেন। জানা গেছে, আমেরিকার টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে আব্দুল হাই বাচ্চু গড়ে তুলেছেন বিশাল খামারবাড়ি।
আট বছরে বিভিন্ন সময়ে বাচ্চুর যোগসূত্র খুঁজে পায়নি দুদক। এ নিয়ে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যানসহ দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা একাধিকার গণমাধ্যমের কাছে দায়সারা বক্তব্য দেন। তারা দাবি করেন সম্পৃক্ততা না পেলে আব্দুল হাই বাচ্চুকে আসামি করার সুযোগ নেই। কিন্তু হঠাৎ করে রহস্যজনক কারণে দুদকের পক্ষ থেকে অফিসিয়ালি বলা হচ্ছে, তিনি শুধু দায়ী নন। এ মামলার অন্যতম আসামি।
হঠাৎ তাদের উলটো সুরের কারণ সম্পর্কে জানা গেছে, উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় সব ধরনের প্রভাব ও চাপ মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তারা তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দুদক চেয়ারম্যানকে বোঝাতে সক্ষম হন যে-বাচ্চুকে বাদ দিয়ে চার্জশিট দিলে তা আদালতে গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে বাচ্চুকে বাদ দিয়ে চার্জশিট দিলে চেয়ারম্যানসহ দুদক কর্মকর্তাদের আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। এছাড়া অপর একটি সূত্র দাবি করেন, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু শর্ত আরোপ করে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি আরোপ করার পর বাচ্চুর বিষয়ে আর কেউ দায়িত্ব নিতে রাজি নন। তারা মনে করছেন, বাচ্চুকে বাদ দেওয়া হলে অনেকের ওপর ভিসানীতি আরোপ হতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের কয়েকটি সূত্র জানায়, দুদক তার ইমেজ সুরক্ষার স্বার্থে শুধু বাচ্চু নয়, সব রাঘববোয়ালকে শক্তভাবে ধরবে।
জানা গেছে, মামলার এজাহারভুক্ত ১২০ আসামির মধ্যে ব্যাংকের যে ৬ কর্মকর্তা ও ২২ ঋণগ্রহীতা জামিন নিতে বিভিন্ন সময়ে আদালতে হাজির হন। তবে কাউকে জামিন দেননি আদালত। পরে বিভিন্ন সময়ে একজন বাদে তাদের সবাই জামিনে মুক্তি পান। বর্তমানে মামলার একমাত্র আসামি হিসাবে বেসিক ব্যাংক শান্তিনগর শাখার সাবেক ম্যানেজার মোহাম্মদ আলী কারাবন্দি আছেন। মামলার এজাহারভুক্ত ১২০ আসামির বাইরে তদন্তে পাওয়া আসামি হিসাবে চার্জশিটে আরও ২৭ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেয়েছিলেন জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ-সদস্য আব্দুল হাই বাচ্চু। ২০১২ সালে তার নিয়োগ নবায়ন করা হয়। ঋণ কেলেঙ্কারির অভিযোগের মুখে ২০১৪ সালে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণের পর চাপ সামলাতে না পেরে পদত্যাগ করেন বাচ্চু। সূত্র-যুগান্তর।
বাংলামেইল৭১/কেএম/বাবু