বাংলামেইল৭১ ডটকম প্রতিবেদক : পুরান ঢাকায় কয়েক হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে লাখ লাখ মানুষ বসবাস করছে। ওই এলাকার সত্তর শতাংশ সরু গলির ভবনগুলোতে প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরির কারখানা, রাসায়নিক গোডাউনের সঙ্গে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষ বসবাস করছে। এসব ভবন তৈরিতে ইমারত নির্মাণ বিধিমালার ন্যূনতমও মানা হয়নি। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এ বিষয়ে নির্বিকার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। দুর্ঘটনার পরে কিছুদিন তোড় জোড়ের পর আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তদারকি কার্যক্রম।
এসব ভবনগুলো কোন অনুমোদন আছে কি-না, আর অনুমোদন থাকলেও বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হওয়ার বিষয়ে ও জানতে পারছেনা ভাড়াটিয়া কিংবা ব্যবহারকারীরা। ফলে নিজের অজান্তেই অনিরাপদ ভবনের ভেতর মর্মান্তিক মৃত্যুর গহবরে ঢুকে যাচ্ছে মানুষ। সম্প্রতি রাজধানীতে ঘটে যাওয়া দুটি মর্মান্তিক ঘটনায় অধিকাংশ ভুক্তভোগীই এমন নির্মমতার শিকার হয়েছে।
জানা গেছে, পুরান ঢাকা জুড়ে কয়েক হাজার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বছরের পর বছর কয়েক লক্ষ মানুষ বসবাস করছে। ঝুঁকিপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী এসব ভবন আবাসিক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়, হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সার্বক্ষণিকভাবে ১০ জন থেকে শুরু করে শতাধিক লোকও একেকটি ভবনে অবস্থান করছে। বর্তমানে নতুন করে নির্মিত ভবনগুলোও জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুযায়ী নির্মিত হচ্ছেনা। সাত মাত্রার ভুমি কম্পন তীব্রতায় এসব গিঞ্জি এলাকা যে কোন সময় লন্ডভন্ড হয়ে ভবন ধসে ভয়াবহ দূর্ঘটনা ঘটতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। কয়েক বছর আগে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ সিটি করপোরেশন ও রাজউক ভবনগুলোতে ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ড লাগিয়েই দায় সেরেছে। তবে কিছু পুরনো ভবনকে হেরিটেজ হিসেবে ঘোষণা করে ভাঙ্গার উপর আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়া অধিকাংশ গলি সরু হওয়ায় জরুরী মুহুর্তে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে পারছেনা। অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র বলছে, পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, টিপু সুলতান রোড, নারিন্দা, নবাবগঞ্জ রোড, লালবাগ, খাজে দেওয়ান, চকবাজার, মিটফোর্ড, ইসলামপুর, জিন্দাবাহার, কসাইটুলি, নাজিরা বাজার, কাপ্তানবাজার, সাতরওজা, সূত্রাপুর, হাজারীবাগ, চকবাজার, বংশাল, কোতোয়ালি, শ্যামপুর ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় কয়েক হাজার জরাজীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ পরিত্যক্ত ভবন রয়েছে। এসব এলাকায় শত বছর কিংবা কয়েকশত বছর পুরানো জরাজীর্ণ ভবনে বংশ পরম্পরায় মানুষ বসবাস করে আসছে। ঝুঁকিপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী এসব ভবন আবাসিক ,বানিজ্যিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান , বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারী হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সার্বক্ষণিকভাবে ১০ জন থেকে শুরু করে শতাধিক লোকও একেকটি ভবনে অবস্থান করছে।
এসব ভবনগুলোর অন্যতম হলো- স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের এডওয়ার্ড বিল্ডিং। বর্তমানে মেডিসিন বিভাগের আবাসিক চিকিৎসা কার্যক্রম, হলরুমসহ ও আরো কয়েকটি বিভাগের চিকিৎসা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। হাসপাতালের অভ্যন্তরে আরো কয়েকটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে কর্মচারীরা বসবাস করছে। তাছাড়া লক্ষীবাজার শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজে ৭৩ বছর পুরানো ঝুঁকিপূর্ণ একটি ভবনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান দেয়া হচ্ছে। এই ভবনটির অবস্থা বেশ করুন। ছাদের পলেস্তার খসে পড়ছে। কঙ্কালের মতো বেরিয়ে আসছে রড। জানালার দেয়ালেও ভাঙ্গন। শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রায়ই তাদের ওপর খসে পড়ে পলেস্তরা। বাধ্য হয়েই ঝুকিপূর্ন এই ভবনে ক্লাশ করছেন তারা।
মালিকনা ভবনগুলোর অবস্থা আরও করুন। বিত্তশালী অধিকাংশ বাড়ির মালিক ভবন ভাড়া দিয়ে অন্যত্র বসবাস করলেও অল্পভাড়ার আশায় অনেকে ভাড়া নিচ্ছে। এছাড়া তুলনামূলক কম বয়সী ভবনগুলো কোন অনুমোদন নেই, আবার কিছু বাড়ির অনুমোদন থাকলেও পূর্বের নকশা বদলে ফেলায় ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) জিওডেসেক কনসালট্যান্টস অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তালিকা করে পুরান ঢাকার ৫৭৩টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করে। এর মধ্যে ১৪৫টিকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়। যার মধ্যে- সূত্রাপুর থানা এলাকায় রয়েছে ১৪৬টি, কোতোয়ালিতে ১২৬টি, হাজারীবাগে ২১টি, লালবাগে ৭৩টি ও শাঁখারীবাজারে ৯১টি। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে পুরান ঢাকার দুই’শো থেকে আড়ই’শো বছরের পুরনো ভবনের সংখ্যা পঁচিশটিরও বেশি বলে জানা গেছে।
এদিকে প্রাচীন ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত ও সংরক্ষিত ভবনগুলো নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দিকনির্দেশনা না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ও ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলো নিয়ে কী করা হবে, সেটা পরিষ্কারভাবে কেউ বলতে পারছে না। কিছু ভবন নিয়ে বিপাকে পড়েছে মালিকরা। এই খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকার চাইলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণ ও নতুন ভবন তৈরিতে তাঁরা সহায়তা দিতে পারেন। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঐতিহ্যবাহী ভবনগুলো সংস্কার ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পথ অনুসরণ করা যায়। এ ক্ষেত্রে ‘আরবান রিজিওনাল প্রজেক্ট’ ধরে কাজ করা যেতে পারে। তবে ব্যাক্তি মালিকানায় থাকা পুরাতন ভবনগুলো নিয়ে বেশ বিপাকে পড়েছেন মালিকরা। আদালতের নিষেধাজ্ঞায় এসব ভবন মেরামত কিংবা তা ভেঙ্গে নতুন ভবন নির্মান করা যাচ্ছেনা। ওইসব মালিকরা সরকারী সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছেন বলে জানান একাধিক ভবন মালিক।
পুরান ঢাকার হাজি আলি হোসেন, সরোয়ারসহ কয়েকজন ভবন মালিক যুগান্তরকে বলেন, বাপ দাদার ভিটা-মাটিতে থাকা বসতবাড়ি কিভাবে ঐতিহাসিক স্থাপনা হয় তা বুঝি না। সবাই বাসা-বাড়ি পুরাতন হলে ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতে পারে। কিন্তু আমরা এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছি। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকায় নির্মাণকাজ করতে পারছি না। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। ভূতাত্ত্বিক গবেষণা বলছে, ঢাকা শহর ভূমিকম্পের জন্য ভয়ানক ঝূঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে পুরান ঢাকা। সাত মাত্রার কম্পন তীব্রতায় পুরান ঢাকার গিঞ্জি এলাকা যে কোন সময় লন্ডভন্ড হয়ে ব্যপক প্রাণহানি ঘটতে পারে। জরাজীর্ণ কয়েকটি ভবনে বসবাসকারী কয়েকজন ভাড়াটিয়া যুগান্তরকে বলেন, বহু পুরাতন ভবন ভেঙ্গে নতুন ভবন নির্মাণ করতে গেলে নানান বিপত্তি। একটি ভবন আরেকটির সঙ্গে গাঁ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়া গোটা এলাকা অনেক গিঞ্জি তাই একটি ভবন ভাঙ্গতে গেলে আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। তাছাড়া নতুন ভবন গড়তে গেলে আমাদের ঠাঁই নেওয়ার মতো কেনো জায়গা নেই। তবে ৩০-৫০ বছরের পুরোনো ভবনের মালিকরাও ভবন ভেঙ্গে নতুন করে ভবন বানাতে রাজি নয় বলে জানান তারা।
এদিকে রাজধানী উন্নয়ন কতৃপক্ষের (রাজউক) একটি জরীপ রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এর মধ্যে ৩২১টি অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। বাকি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো দীর্ঘদিন ধরে আগের অবস্থায় রয়েছে। এসব ভবনের অধিকাংশই পুরান ঢাকার উল্লেখিত এলাকা সমূহে। তবে এর পরও গত বছর নতুন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করেছিল রাজউক। কিন্তু সে তালিকায় কতগুলো ভবনকে চিহ্নিত করা হয়েছে তা স্পষ্ট করেনি রাজউক কর্তৃপক্ষ। রাজউকের নগর পরিকল্পনা শাখার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, নগরীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পুরোনো যে তালিকা ছিল, সেটা ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু তারা এ ব্যাপারে এখনও কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। তিনি জানান, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর তালিকা পাওয়ার পর তারা ব্যবস্থা নেবেন কি নেবেন না এটা তাদের ব্যাপার। এছাড়া রাজউক কর্তৃক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে যে জনবল দরকার তা নেই। যে কারণে তালিকা থাকার পরও ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে অনেক সময় বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কখনও কখনও ওপর মহলের অনুরোধ রাখতে গিয়ে তালিকায় থাকার পরও কিছু করা সম্ভব হয় না।
এসব বিষয় বক্তব্য জানতে রাজউক চেয়ারম্যান মোঃ আনিসুর রহমান মিঞার সরকারী মোবাইল ফোনে বারবার কল করলেও তিনি সাড়া দেননি।
সম্প্রতি এ বিষয়ে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল রাশিদুন নবী বলেন, এর্ডওয়ার্ড বিল্ডিংটি ঝুঁকিপূর্ণ নয়, কয়েক বছর আগে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পর আবারো টেকনিক্যাল কমিটি বসে রিপিয়ারিং এর মাধ্যমে আরো তিন বছর ব্যবহার করা যাবে বলে ২০২২ সালে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এজন্য ভবনটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া আরো কয়েকটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে কর্মচারীরা বসবাস করছে বলে স্বীকার করে তিনি বলেন, এসব ভবনে যারা থাকছে, তাদেরকে বারবার সতর্ক করা হচ্ছে। প্রতিবছর বড় বড় সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেওয়া হচ্ছে । তারপরও তারা ওসব ভবন ছাড়ছে না বলে জানান তিনি।
বাংলামেইল৭১ডটকম/কেএম/সাআ